দড়ি দিয়ে তৈরি পোর্ট্রেট — বাবা-মায়ের জন্য একটি হৃদয়ছোঁয়া উপহার

দড়ি দিয়ে বানানো বাবা-মায়ের পোর্ট্রেট, বিবাহবার্ষিকীর উপহার
সব উপহার শুধু চোখে ভালো লাগার জন্য হয় না। কিছু উপহার থাকে, যেগুলোর প্রতিটা বিন্দু জুড়ে থাকে সময়, পরিশ্রম, ভালবাসা আর স্মৃতি। এটি তেমনই একটি গল্প—একজন হস্তশিল্পীর হস্তশিল্প উপহারের, যা এখন রয়েছে আমার বাবার-মায়ের ঘরের দেওয়ালে, তাঁদের বিছানার ঠিক উপরে। ঘরে কেউ ঢুকলে চোখ সোজা চলে যায় সেই ছবিটার দিকে—দড়ি দিয়ে তৈরি আমার বাবা-মায়ের যুগল প্রতিচ্ছবি।
১. RCP তৈরির শুরুটা কি ভাবে হয়েছিল?
২০২৩ সালের শেষ দিকে আমি রোপ ক্র্যাফট এর কাজ শুরু করি। প্রথমে ঠাকুর-দেবদেবীর ছবি বানাতাম। তারপর একদিন ভাবলাম—এবার কিছু নিজের, কিছু ব্যক্তিগত কিছু বানানো যাক। শুরু হল মানুষের আসল মুখ দেখে দড়ির শিল্প বানানো। এই নিয়ে গল্প অন্য কোনো ব্লগে বলব। ধীরে ধীরে স্কিল বাড়ল, সাহস এল। আর তারপর এল জীবনের সবচেয়ে আবেগঘন প্রজেক্ট—বাবা-মায়ের জন্য বিবাহবার্ষিকীতে এক সারপ্রাইজ উপহার।
এই ভাবনাটা জন্মেছিল ভালবাসা থেকে। আমি চেয়েছিলাম শুধু আর্ট না, একটা উপস্থিতি তৈরি হোক—যেন দড়ির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন বাবা আর মা, পাশাপাশি।
২. এই উপহার বানানর কাজের চ্যালেঞ্জ কি ছিল?
শুরু করলাম দুটি আলাদা আলাদা ছবি নিয়ে—একটি বাবার, একটি মায়ের। আলাদা ছবি হওয়ায় প্রথম চ্যালেঞ্জই ছিল আলো-ছায়া। দুজনের মুখে আলোর দিক ছিল আলাদা, ছায়ার অবস্থানও তাই। এই পার্থক্য মেটাতে আমাকে অনেক কল্পনা করতে হয়েছে যাতে শেষমেশ ছবিটা যেন বেমানান না দেখায়।
দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ছিল মুখের সাইজ। আলাদা আলাদা ছবির কারণে স্কেল এক করতে অনেক সময় লাগলো। প্রথমে ডিজিটালভাবে মুখের আকার গুছিয়ে তবেই শুরু করলাম হাতে কাজ। এই ধরণের যুগল প্রতিকৃতি তখনই ঠিক লাগে, যখন দুই মুখে একটা তাল-মিল থাকে।
৩. পুনরায় প্রচেষ্টা: ভালো না লাগায় আবার শুরু
প্রথম ভার্সনটা শেষ করতে ৫–৬ দিন আর ঘন্টায় হিসাব করলে মোট ২০ ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছিল। কিন্তু শেষে নিজেই বুঝলাম—এটা ঠিক মিলছে না। মুখের আদলে কেমন যেন কিছু কম। আমি নিজেই সেটায় মন ভরাতে পারিনি, তখন তাই সেই ছবি কোনো কাজের নয় সেটা নিশ্চিত করে ফেললাম।
হ্যাঁ, আমি সেই আর্ট টা সরিয়ে রেখে আবার নতুন করে শুরু করলাম। কারণ দড়ির প্রতিটি পাক আমার কাছে একেকটা অনুভূতির মতো। মুখ ঠিক না হলে, আত্মাটা আসে না।
দ্বিতীয়বারেও ৫–৬ দিন লেগে গেল, আবারও ২০ ঘণ্টার বেশি সময়, কিন্তু এবার কাজটা শেষ করে আমি নিজে অনুভব করলাম—হ্যাঁ, এটা পারফেক্ট। তবে পারফেক্ট বলে কিছু হয় না। যেটা বানিয়েছি তার থেকেও ভালো হতে পারত, কিন্তু ছবি দেখে আমি সেটিসফাইড ছিলাম।
৪. শিল্পকর্ম শেষ করা এবং উপহার তুলে দেওয়া
এরপরে আর্ট টা বাঁধিয়ে ফেললাম প্রিমিয়াম ১৮x১২ ইঞ্চির কালো ফ্রেমে। সিম্পল কিন্তু ক্লাসি।
উপহার দেওয়ার পরে বাবা-মা দেখেই চমকে গেলেন। সম্পূর্ণ সারপ্রাইজ। দুজনের চোখে বিস্ময় আর আনন্দ—কী বলবো! এখন ছবিটা বাবার-মায়ের ঘরে তাঁদের বিছানার উপরে টাঙানো। আগে যেখানে সাদামাটা দেওয়াল ছিল, এখন সেখানে থাকে উষ্ণতা, ভালবাসা। এই ফ্রেম দেওয়ালের সৌন্দর্যও বাড়িয়ে দিয়েছে।
যে-ই ঘরে ঢোকে, একবার না একবার তাকিয়ে দেখে। আর সেই মুহূর্তেই শিল্পটা সকলের মন আকর্ষণ করে — অনেকেই ভাবে যদি তাদের ছবিও এমন ভাবে তৈরি করে ঘরের সজ্জা বৃদ্ধি করত তাহলে কতই না ভালো লাগতো।
৫. অনুভবে গাঁথা কারুকাজ
দড়ির প্রতিকৃতি আঁকা মানে কিন্তু রঙে ছবি আঁকা নয়। এখানে রঙ থাকে মাত্র দুইটি—প্রাকৃতিক রঙের কটন আর পাট দড়ি। ছায়া আর মুখের বেঁকে থাকা জায়গা ফুটিয়ে তোলা এত কম রঙে সত্যিই খুব চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু এখানেই তো এই আর্টের সৌন্দর্য।
যখন কেউ আমায় ছবি বানাতে দেন, আমি শুধু চেহারার মিল নয়—ব্যক্তিত্বটাও ধরতে চাই। যাতে দেখেই মানুষ বলতে পারে—‘এ তো আমার বাবা’, বা ‘এ তো আমার মায়ের হাসি’ বা ‘এই তো সেই আমার চেনা মানুষ টা’। যদি সেটা না আসে, আমি আবার বানাতে রাজি। কারণ শিল্পের থেকে বেশি জরুরি অনুভবটা।
প্রতি মুখ বানাতে সময় লাগে প্রায় ১০–১২ ঘণ্টা। এই ডুয়াল পোর্ট্রেট বানাতে লেগেছে ২০ ঘণ্টারও বেশি। তবে সময় এখানে কোনো মানে রাখে না, কারণ উপাদানটাই যদি হয় ভালবাসা, তাহলে সময় গোনার প্রয়োজন হয় না।
৬. উপহার যার মূল্য অর্থে হয় না
এই ধরনের Rope Craft Portrait মাঝে মাঝে প্র্যাকটিসের জন্য আমি আমার পরিচিত মানুষদের ছবি দিয়ে বানাই, তবে সেগুলো রেখে দিই নিজের কাছে—কারণ প্রতিটা কাজে একটা টান থেকে যায়।
আমি খুব কাছের মানুষ ছাড়া কাউকে আমার হাতে বানানো কিছু উপহার দিই না।
এইটা ছিল আমার বাবা-মায়ের জন্য। আরেকটা বানিয়েছিলাম আমার প্রিয় এক স্যারের জন্য, আর সেটা আমি তাঁকে উপহারও দিয়েছিলাম।
সে গল্প, আরেক ব্লগে বলবো।
এই দড়ির প্রতিচ্ছবিগুলো আসলে একটা অনুভব, একটা স্মৃতি—যা সময়কে ছাপিয়ে বেঁচে থাকে।
৭. উপসংহার: গল্পগুলো থেকে যায়
এই পোর্ট্রেট এখন শুধু আমাদের ঘরের অংশ না, এটা আমাদের জীবনের অংশ। আমার বাবা-মায়ের সাথে আমার সম্পর্কের প্রতীক। এক শিল্প যা একটা সময়ে শুরু হয়েছিল নতুন কিছু শেখার জন্য, আর এখন তা হয়ে উঠেছে অনুভবের ভাষা।
এই ধরনের ছবির প্রতিটি দড়ির পাকের মধ্যে আছে অনেক অনেক আন্তরিকতা এবং ভালবাসা — এটাই হল এই RCP এর ‘Story Behind the Craft’।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। আরও এই ধরনের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া হস্তশিল্প দেখতে, তার পিছনের গল্প জানতে, কিংবা আপনার প্রিয় মানুষদের জন্য কাস্টম অর্ডার করতে ঘুরে আসুন Upahar18 এর ওয়েবসাইটে।
নিচে কিছু Rope Craft Portrait-এর ভ্যারাইটি লিঙ্ক শেয়ার করা হল — পছন্দমতো বেছে নিতে পারেন: